প্রকাশিত: Fri, Dec 30, 2022 3:42 PM
আপডেট: Mon, May 12, 2025 6:16 AM

বিশে^র দুই পরাশক্তির শক্তি প্রদর্শন এবং বাংলাদেশ

আতিকুজ্জামান ফিলিপ

যারা নিয়মিত দেশ-বিদেশের খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে বাদানুবাদ শুরু হয়েছে। আমেরিকা সেই শুরু থেকেই বংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলিয়ে আসছে, কিন্তু বর্তমান সময়ে তাদের নাক গলানোটা এতোটাই উলঙ্গ হয়ে পড়েছে যে, তারা এখন আর কোনো রাখঢাক রাখছে না। আমাদের মানবাধিকার নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে, আমাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড (ক্রসফায়ার) নিয়ে তারা কথা তোলে, যদিও তারা নিজেরা প্রতিবছর কতো যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, সেটা নিয়ে কোনো আলাপই করে না। 

আমাদের নির্বাচন নিয়ে তারা নাক গলায়, আমাদের নির্বাচন নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলেÑ এটা নতুন কিছু নয়। তবে বর্তমান সময়ে তারা এতোটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছে যে, এখন তাদের রাষ্ট্রদূত আমাদের সরকারকে ন্যূনতম অবহিত করার শিষ্টাচার ব্যতিরেকেই সরাসরি বিরোধী দলের আমন্ত্রণে তাদের বাড়িতে গিয়ে তাদের সরকারবিরোধী সভায় যোগ দিচ্ছে এবং তাদের সরকারবিরোধী প্রচারণা ও কর্মকাণ্ডে উৎসাহ যোগাচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমেরিকানদের এমন অনাধিকার চর্চা ও অযাচিত হস্তক্ষেপের ব্যাপারে এতোদিন পর্যন্ত রাশিয়া সরাসরি কোনোরকম উৎসাহ দেখায়নি, প্রকাশ্যে ন্যূনতম কোনো মন্তব্যও করেনি। কিন্তু এবার আমরা লক্ষ্য করলাম মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এহেন আচরণে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত কড়া ভাষায় টুইট করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার অন্য কোনো রাষ্ট্রের নেই।’ তার এই টুইটের জবাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পাল্টা টুইট করে বলেছেন, ‘এটা কি ইউক্রেনে মানা হয়েছে?’ আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এই বাদানুবাদ শুধু রাষ্ট্রদূতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, শুধু আমাদের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সুদূর আমেরিকা ও রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্তও গড়িয়েছে। 

কয়েকদিন আগে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষার নামে ক্রমাগত দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন, যা মোটেও গ্রহনযোগ্য নয়।’ আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়ার এমন মার্কিনবিরোধী ভূমিকায় আমাদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই লক্ষ্য করবেন, রাশিয়ার এই ভূমিকায় আমাদের এতোটা আহ্লাদিত বা খুশি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাশিয়া যে আমাদের স্বার্থেই এমন করছে, ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়। যদি তেমনই হতো তবে প্রথম থেকেই আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিনিদের নাক গলানোর ব্যাপারে রাশিয়া উচ্চকিত ভূমিকা রাখতো। ইউক্রেন ইস্যুতে আমেরিকার সাথে রাশানদের যে বৈরিতা চলছে তারই ফলশ্রুতিতে রাশিয়া এই মুহূর্তে আমাদের ইস্যূতে আমেরিকার বিরুদ্ধে এতোটা সোচ্চার আচরন করছে। বস্তুত রাশিয়ার এই আচরণের মধ্যে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। যদি তাই হতো তবে সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতেও রাশিয়া আমাদের পাশে থাকতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে রোহিঙ্গা ইস্যূতে আমরা রাশিয়াকে কাছে পাইনি। বরং রোহিঙ্গা ইস্যূতে রাশিয়া বরাবর মিয়ানমারকে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বলা যায় একারণেই রোহিঙ্গা ইসূ্যূতে এখনো পর্যন্ত আমরা আশানুরুপ কোনো ফল পাচ্ছি না। 

ভারতও এই ইস্যুতে আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার বন্ধুত্বসুলভ সহযোগিতার কারণেই আমেরিকা তার আগ্রাসী ভূমিকা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকেও রাশিয়া সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে এসেছে। এমনকি এখনো পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে বড় মেগাপ্রজেক্ট ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’ রাশিয়ার বিনিয়োগেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। বস্তুত আমাদের সাথে 

বন্ধুত্বের বিচারে রাশিয়া সবসময়ই আমেরিকার চেয়ে এগিয়ে ছিলো, তবুও আমরা রাশিয়ার দিকে কখনোই পুরোদমে ঝুকতে পারিনি। ‘কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব’ আমাদের এই পররাষ্ট্রনীতির কারণেই আমরা সেটা করতে পারিনি, এখনো পারবো না। আমাদের মতো দুর্বল সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিসম্পন্ন দেশের পক্ষে এটাই লাভজনক পররাষ্ট্রনীতি, এটাই যৌক্তিক কূটনীতি। 

সুখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশকে নিয়ে আমেরিকা-রাশানদের এই দ্বৈরথ এখন পর্যন্ত আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথেষ্ট দক্ষতার সাথে সামাল দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমরা চাই, প্রত্যেক দেশে যে নিয়ম আছে, জেনেভা কনভেনশন আছে, সে অনুযায়ী কাজ করবে, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না। আমরা পরিপক্ক, স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ এটা সবার মনে রাখা উচিত। আমার এ বক্তব্য রাশিয়া, আমেরিকার সবার জন্য প্রযোজ্য।’ 

বাস্তবিক অর্থেই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোনো পন্থা হতে পারে না। কারণ আমরা চাই না, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে ইস্যুকে করে দুই পরাশক্তি এখানে তাদের শক্তি প্রদর্শনে জড়িয়ে পড়ুক। আমরা চাই না, তাদের স্বার্থসিদ্ধির কোপানলে পড়ে আমরা ক্ষত-বিক্ষত হই। ফেসবুক থেকে